কাতারের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের ২৫৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া — দাবী অসত্য, বিভ্রান্তিকর এবং রাজনৈতিক উদেশ্যপ্রণেদিত।
জুলাই,আগস্টে চলা রাজনৈতিক দাঙ্গায় দেশের অর্থনীতি প্রায় ৫০ দিনের অধিক স্থবির ছিল,বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি ও ডলার সংকটের কারণে বকেয়া পরিশোধে বিলম্ব হওয়া আংশিকভাবে স্বাভাবিক। তবে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব, বিকল্প জ্বালানির উৎস অনুসন্ধানে বিলম্ব এবং দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ইউনূস সরকারের আমলে আমদানিকৃত তরল গ্যাসের পাওনা পরিশোধ না করে, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উপর দায় চাপানো সম্পূর্ণ সত্য নয়।
ফ্যাক্টচেক
এম আখতার মুকুল
4/27/20251 মিনিট পড়ুন


দাবী:
গত ২৪ এ এপ্রিল সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের প্রেসসচিব তার ভেরিফায়েড আইডি থেকে শফিকুল ইসলাম সময় সংবাদের অফিসিয়াল ফেসবুক রিপোর্ট শেয়ার করে বলেছেন “রিপোর্ট আওয়ামী লীগ সরকার কাতার থেকে জ্বালানি কিনে ২৫৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রেখে গিয়েছে।”
ফ্যাক্ট চেক:
এই দাবীটি অসত্য,বিভ্রান্তিকর এবং রাজনৈতিক উদেশ্যপ্রণেদিত।
বিশ্লেষণ:
শফিকুল ইসলামের শেয়ার করা তথ্যটি একটি আংশিক সত্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি এবং সম্পূর্ণ চিত্রটি উপস্থাপন করে না। কাতারের কাছে ২৫৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া থাকার বিষয়টি সত্য, তবে এর পেছনের কারণ এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট উল্লেখ না করে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করা বিভ্রান্তিকর।
বকেয়া থাকার মূল কারণসমূহ:
রাজনৈতিক দাঙ্গা : ২০২৪ সালের জুলাই মাসের দাঙ্গা ও ছাত্র আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আন্তর্জাতিক লেনদেন এবং বকেয়া পরিশোধে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়।
জ্বালানি খাতে বিশাল চাহিদা: জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে প্রতি মাসে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হলেও সময়মতো সেই পরিমাণ ডলার সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি ও অন্যান্য জ্বালানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, ফলে আমদানি ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পায়।
রাজস্ব ঘাটতি: সরকার উচ্চ মূল্যে এলএনজি কিনে কম দামে বিক্রি করায় রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয়, যা বকেয়া পরিশোধে প্রভাব ফেলে।
ডলার সংকট: ২০২২-২৩ সাল থেকে বাংলাদেশে তীব্র ডলার সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিদিন ৪০ মিলিয়ন ডলার সরবরাহের প্রয়োজন থাকলেও সরবরাহ ছিল মাত্র ৫-৭ মিলিয়ন ডলার।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও এই তথ্যগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছেঃ
দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪): এই পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, কাতার ও ওমানের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় আমদানি করা এলএনজির বিল ছাড়াও স্পট মার্কেট থেকে জুলাই ও আগস্ট মাসের এলএনজির বিল বকেয়া ছিল। জুলাই আগস্টে দাঙ্গায়বাংলাদেশের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছেদ পড়ে, সকল ধরণের প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির ছিল।
ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস (৮ ফেব্রুয়ারি ,২০২৫ সালের রিপোর্ট): এই পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসের শেষ নাগাদ শুধুমাত্র কাতার এনার্জির কাছেই প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া ছিল এবং কোনো কোনো চালানের বিল ডেলিভারির ৪৬ দিন পর্যন্ত অপরিশোধিত ছিল। পেট্রোবাংলা ও কাতারগ্যাসের মধ্যেকার চুক্তি অনুযায়ী, এলএনজি সরবরাহের ১৫ দিনের মধ্যে বিল পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই রিপোর্টে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং এর ফলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাওয়াকে বকেয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩): এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হলেও তার অর্ধেকেরও কম সরবরাহ করা হচ্ছিল। ফলে এই দুটি খাতের মোট বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, যার মধ্যে জ্বালানি খাতের বকেয়া ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
বকেয়া বিল পরিশোধ না হওয়ার মূল কারণঃ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের নয় মাস পর পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাতার সফরকালে কাতার এনার্জির কাছে সমস্ত বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। এবং ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে সমস্ত বকেয়া পরিশোধ সম্পন্ন হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ গত নয় মাসেও কোন বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি, এমকি যে পরিমাণ তরল গ্যাস ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমদানি করা হয়েছিল তার বকেয়া অপরিশোধিত ছিল। যদিও চুক্তি অনুযায়ী শিপমেন্টের ১৫ দিনের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করতে হবে, ইউনূস সরকার তা করেনি। অথচ গত নয় মাসে কয়েকবার কাতার থেকে এল এন জি গ্যাস আমদানি করেছে। কাতারের বকেয়া পরিশোধে ইউনূসের গাফিলতি স্পষ্ট।
এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে জ্বালানি মন্ত্রনালয়ের এক কর্মকর্তা জানান "রাশিয়ার এবং ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার ফলে তেল এবং শস্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আর এটাই দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। অর্থাৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার বক্তব্যে পরিস্কার বিল বকেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী নয়। বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দেশব্যাপী জুলাই আগস্ট মাস ধরে চলা নজিরবিহীন দাঙ্গা আওয়ামী লীগ সরকারের কাতারের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে না পারার মূল কারণ।
জুলাই,আগস্টে চলা রাজনৈতিক দাঙ্গায় দেশের অর্থনীতি প্রায় ৫০ দিনের অধিক স্থবির ছিল,বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি ও ডলার সংকটের কারণে বকেয়া পরিশোধে বিলম্ব হওয়া আংশিকভাবে স্বাভাবিক। তবে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব, বিকল্প জ্বালানির উৎস অনুসন্ধানে বিলম্ব এবং দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ইউনূস সরকারের আমলে আমদানিকৃত তরল গ্যাসের পাওনা পরিশোধ না করে, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উপর দায় চাপানো সম্পূর্ণ সত্য নয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের প্রেসসচিব শফিকুল ইসলামের দাবী যে "আওয়ামী লীগ সরকার কাতার থেকে জ্বালানি কিনে ২৫৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রেখে গিয়েছে" — এটি একটি অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য। তারা সরকারে থেকেও নয় মাসে নিজেদের বকেয়া পরিশোধ না করে আওয়ামী লীগের দায় চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা রাজনৈতিক উদেশ্যপ্রণেদিত। কাতারের বকেয়া থাকার পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল, যার মধ্যে জুলাই আগস্টে সংঘটিত রাজনৈতিক দাঙ্গা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ডলার সংকট অন্যতম।
অতএব, কাতারের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের ২৫৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া — দাবী অসত্য, বিভ্রান্তিকর এবং রাজনৈতিক উদেশ্যপ্রণেদিত।