সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ‘৩০০০ আলেম হত্যার’ দাবি— সম্পূর্ণ মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতি
সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ৩০০০ আলেমকে হত্যার মিথ্যা দাবি ফেসবুক,ইউটিউব এবং ,সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। চেকপয়েন্টের অনুসন্ধানে সমকালীন ঐতিহাসিক সূত্র ও আধুনিক একাডেমিক গবেষণায় এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ নেই; বরং সালাহউদ্দিন এর শাসনামলকে অনেক ঐতিহাসিকই দয়া ও ধর্মীয় সহাবস্থার উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ফ্যাক্টচেক
এম আখতার মুকুল
12/3/20251 মিনিট পড়ুন


দাবিঃ আলোর রশ্মি নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে দাবি করা হয়ঃ কেন সালাউদ্দিন আয়ুবী ৩০০০ আলেম কে হত্যা করেছিলেন? যদি ১ হাজার বছর পূর্বে মুসলিম সমাজে ৩ হাজার ইমাম বা আলেম বেশধারী ইহুদি থাকতে পারে, তাহলে বর্তমানে আখেরী যামানায় কত সংখ্যক ইহুদী চর থাকতে তা কল্পনাতীত বিষয়। ভিডিওটি ফেসবুকে আপ্লোড করা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি ,২০২২। ১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ভিডিওটি ১১ মিলিয়ন ভিউ , ১ লক্ষ ৯১ হাজার বার ভিডিও টি শেয়ার করা হয়। লিংক এখানেঃ লিংক ১, লিংক ২, লিংক ৩। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও এই নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও এই নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। লিংকঃ লিংক ২
ইউটিউবেও একটি ভিডিও দেখা যায় একজন বক্তা ৩০০০ হাজার আলেম হত্যার কথা ওয়াজ মাহফিলে ঘোষণা করছেন , Muslim tv নামক একটি চ্যানেল থেকে যেটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রায় ৪৫ লক্ষ
দাবির সত্যতা যাচাইঃ
দাবির সত্যতা যাছাইয়ের জন্য চেকপয়েন্ট অনুসন্ধান করে এ দাবির স্বপক্ষে। ব্রিটানিকা এন্সাক্লিপিডিয়ার ভাষ্য মতে যুদ্ধ জয়ের পরে খ্রিস্টান, ইহুদি সবাইকে ক্ষমা করে দেন। সালাউদ্দিন আইয়ুবি যুদ্ধ জয়ের পরে ১১৯২ সালে রাজা রিচার্ড দ্য লায়ন হার্টের সাথে শান্তিচুক্তি করেন এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের উদার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সালাহউদ্দিন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার ছিলেন এবং তার উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকেই ইহুদি ছিলেন।
সালাহউদ্দিন আয়ুবী ৩০০০ আলেমকে হত্যা করেছিলেন,এ ধরনের দাবি কোনও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায় না। সালাহউদ্দিনের সমকালীন যে মুসলিম ইতিহাসকাররা তাঁর শাসনকাল বিস্তারিতভাবে লিখে গেছেন, ইমাদ আদ-দীন আল-ইসফাহানি, বেহা আদ-দীন ইবন শাদ্দাদ এবং ইবন আল-আসির, তাঁদের কেউই এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ করেননি। Al-Fath al-Qussi fi’l-Fath al-Qudsi, Al-Nawadir al-Sultaniyya এবং Al-Kamil fi al-Tarikh এসব ক্ল্যাসিক্যাল আরব গ্রন্থে সালাহউদ্দিনের রাজনৈতিক সংস্কার, যুদ্ধনীতি, জেরুজালেম বিজয় এবং ফাতেমিদ শাসনের পতন বিস্তারিত নথিভুক্ত আছে, কিন্তু “আলেম গণহত্যা”র মতো কোনো ঘটনার তথ্য নেই। প্রখ্যাত আধুনিক গবেষক Stanley Lane-Poole, Malcolm C. Lyons, Carole Hillenbrand এবং Andrew Ehrenkreutz যাঁরা সালাহউদ্দিন ও ক্রুসেড নিয়ে প্রামাণ্য গবেষণা করেছেন তাঁদের বইতেও এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। শিয়া ইতিহাস নিয়ে লেখা Heinz Halm-এর The Fatimids and their Traditions of Learning–এও ফাতেমিদ পতনের সময় সালাহউদ্দিন কোনো গণহত্যা করেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সব মিলিয়ে দেখা যায়, এই দাবি মূলত আধুনিক সময়ের একটি গুজব বা ভুল ব্যাখ্যার ফল, যা ইতিহাসসম্মত উৎসসমূহ দ্বারা সমর্থিত নয়।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ৩০০০ আলেমকে হত্যা করেছিলেন—এমন একটি দাবি গত তিন বছরে ফেসবুক, ইউটিউব এবং বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। চেকপয়েন্টের অনুসন্ধান বলছে, ইতিহাসের কোনও নির্ভরযোগ্য উৎসেই এ ধরনের ঘটনার প্রমাণ নেই। বরং সালাহউদ্দিনকে অধিকাংশ ঐতিহাসিক দয়া, ধর্মীয় সহাবস্থান ও মানবিকতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, এই দাবি মূলত ইহুদি ও শিয়া বিরোধী একটি আধুনিক রাজনৈতিক-ধর্মীয় প্রচারণার অংশ, যার সত্যতা নেই।
বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় ইতিহাস বিকৃতির এমন ঘটনা নতুন নয়; বরং এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রায়ই নজরে আসে। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাগুলো সাধারণত রাজনৈতিক ভুল তথ্য যাচাইয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, ফলে ধর্মীয় বিভ্রান্তিমূলক দাবিগুলো অনেক সময়ই অযাচাইকৃত থেকে যায়। এর সুযোগে ধর্মীয় ভুল তথ্য অবাধে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ ইতিহাস, মতাদর্শ ও বিভিন্ন সম্প্রদায় সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে। এসব ভুল ব্যাখ্যা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে না, বরং সামাজিক অসহিষ্ণুতাও বৃদ্ধি করে। দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের ভুল তথ্য সমাজে বিভাজনকে তীব্রতর করতে পারে এবং সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

